শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন টানা ১০ বছরের শাসনে সরকারি কর্মচারীরা কোনো সুবিধা দাবি করেছেন কিন্তু পাননি, এমন ঘটনা ঘটেনি। উল্টো না চাইলেও কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর তুলনামূলকভাবে এত সুবিধা আর কোনো সময়ই পাননি তাঁরা। কিন্তু সরকার তার কর্মচারীদের বেতন পর্যাপ্ত বৃদ্ধির পরও সেবা পেতে ঘুষ গুনতে হয় মানুষকে। ২০১৫ সালে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করার দুই বছর পর সরকারি দপ্তরে ঘুষের পরিমাণ বাড়ে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। ওই বেতন বৃদ্ধির আগে ও পরে টিআইবির করা খানা জরিপে এ চিত্র উঠে আসে। যদিও তখন সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণাকালে দুর্নীতি কমে সেবার মান বাড়ার আশা করেছিলেন নীতিনির্ধারকরা। এরই মধ্যে আজ তৃতীয় জাতীয় জনসেবা দিবস পালন করা হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রতি দু-তিন বছর পর পর ১৬টি বিষয়ের ওপর খানা জরিপ পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৫ সালের খানা জরিপ অনুযায়ী, ওই বছর দেশের মানুষ বিভিন্ন সেবা পেতে সরকারি অফিসে আট হাজার ৮২১ কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে ব্যয় করেছে। ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর ঘুষ লেনদেন হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করার দুই বছরে ঘুষের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
এ প্রতিবেদনে ১৬টি খাতের মধ্যে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে ৯টি খাতে ঘুষের পরিমাণ বেড়েছে, কমেছে ছয়টিতে। দুর্নীতি বেড়েছে গ্যাস, কৃষি, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, বিআরটিএ, স্বাস্থ্য, বীমা, এনজিওতে। আর দুর্নীতি সামান্য কমেছে, শিক্ষা, পাসপোর্ট, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি, কর ও শুল্ক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায়।
২০১৫ সালে বেতন বৃদ্ধির সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘কর্মচারীদের বেতন কম, তারা একটু ঘুষটুস খায়। আশা করছি এখন সরকারি চাকুরেরা বেতন কম এই অভিযোগ আর করতে পারবেন না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোবাশ্বের মোনেম ভোরের প্রভাতকে বলেছেন, ‘এখনো পর্যন্ত জনপ্রশাসনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্নীতি প্রতিরোধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। তাঁর মতে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে ধরনের আইনি কাঠামো দরকার তার কমবেশি আমাদের আছে; কিন্তু সেটা প্রয়োগ করা হয় না।’
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বৈশ্বিক বিনিয়োগসংক্রান্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে যে তিনটি বিষয়কে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, তার মধ্যে প্রথমটিই হচ্ছে দুর্নীতি। প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সরকারি ক্রয়, শুল্ক ও কর সংগ্রহ এবং নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি সাধারণ বিষয়। ঘুষের কারণে বাংলাদেশের জিডিপি ২ থেকে ৩ শতাংশ কম হয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ভোরের প্রভাতকে বলেন, দুর্নীতি হচ্ছে দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা সমস্যা। এর সমাধান চাইলে সমস্যাটা স্বীকার করতে হবে। নীতিনির্ধারক মহল থেকে এমন মানসিকতা পেলে সেটা সম্ভব।
গত বৃহস্পতিবার দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন কমিশনারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসার দুর্নীতির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে তা প্রতিরোধের অনুরোধ জানিয়েছে। দুদকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই বিল তুলে নেওয়া, আর্থিক দুর্নীতির পথ সুগম করতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো, ওভারটাইম না করে বিল নেওয়াসহ ১১টি বিষয়ে দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ তোলা হয়েছে। আর এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, প্রকল্প পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা।
জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের সঙ্গে কোনো অনুষ্ঠান থাকলে দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়টি অবধারিতভাবেই চলে আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। গত ১৩ জুলাই তাঁর কার্যালয়ে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি যেন উন্নয়ন খেয়ে না ফেলে। এর আগে গত ১৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে বলেছিলেন, সরকারি কর্মচারীদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। এত বেতন বাড়িয়েছে, এর পরও দুর্নীতি হবে কেন?
আর্থিক দুর্নীতির অন্যতম বড় অভিযোগ ওঠে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে। নিয়মানুযায়ী কোনো নিয়োগে দুর্নীতি হলে সেটা গণমাধ্যমে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ পায়। কিন্তু সম্প্রতি দেশের নারায়ণগঞ্জ, শেরপুর, মেহেরপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় কনস্টেবল নিয়োগে দুর্নীতি হয়নি বলে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে প্রতীয়মান হয়, এসব নিয়োগে ঘুষই প্রতিষ্ঠিত নিয়ম হয়ে গেছে। ঘুষ ছাড়া নিয়োগ হলেই বরং সেটা ব্যতিক্রম ঘটনা হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে।
সাবেক জনপ্রশাসনসচিব ও বর্তমানে দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্বরত ড. মোজাম্মেল হক খান ভোরের প্রভাতকে বলেন, ‘বেতন বৃদ্ধির ফলে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বঞ্চনার যে আক্ষেপটা ছিল, সেটা ঘুচেছে। দুর্নীতি করার জন্য যে সর্বগ্রাসী প্রচেষ্টা ছিল, সেটা কমেছে। তবে কিছু দপ্তরের দুর্নীতি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। সেসব জায়গায় মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে, আমরা সেই চেষ্টাই করছি।’