ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে মশাখালী-কাওরাইদ স্টেশন। এর ভেতর দিয়ে চলে গেছে শীলা নদী। নদীটির ওপর একটি রেলব্রিজ। ব্রিজ পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে হতাহতের মতো ঘটনাও অনেকবার ঘটেছে। তবু থেমে নেই মানুষের পার হওয়া।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ হাজারো মানুষকে চলাচল করতে হচ্ছে এভাবে। কেননা, নেই বিকল্প কোনো উপায় নেই। ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের এই রেলব্রিজটিও বয়সের ভারে নড়বড়ে।
ব্রিটিশ আমলে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ স্থাপনের সময় মশাখালী ও কাওরাইদ রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী শীলা নদীর ওপর এই রেলব্রিজটি নির্মাণ করা হয়। রেল লাইনের পাশে পাকা সড়ক থাকলেও নদী পাড় হওয়ার জন্য কোনো খেয়া নৌকা বা সড়ক ব্রিজ নেই। ফলে দুই পারের হাজারো মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেলব্রিজের ওপর দিয়ে পার হন। তবে এরশাদ সরকারের আমলে শীলা রেলব্রিজের পাশের নদীতে বাঁধ তৈরি করে সেচ কাজের জন্য অপরিকল্পিতভাবে একটি স্লুইসগেইট নির্মাণ করা হয়। তখন দুই পারের মানুষ স্লুইসগেইটের জন্য নির্মিত বাঁধের ওপর দিয়ে চলাচল করতো। কিন্তু বর্ষাকালে বাঁধের জন্য জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় বাঁধটি কেটে দেওয়া হয়। এতে লোকজনের চলাচলের পথটিও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে মানুষ রেলব্রিজের ওপর দিয়ে চলাচল করে।
শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজের ওপর দিয়ে অসংখ্য নারী-পুরুষ যাতায়াত করছে। ব্রিজের দুইপাশে রেলিং নেই, কাঠের স্লিপারগুলো দীর্ঘদিনে পঁচে ক্ষয় হয়ে গেছে। নাট-ভল্টুগুলো নড়বড়ে, কোন কোন স্লিপারে নাট-ভল্টুও নেই। স্লিপারগুলোকে শক্ত করার জন্য দুই পাশে রেল দিয়ে টানা দেওয়া ছিল। কিন্তু টানা দেওয়া রেল কে বা কারা খুলে নিয়ে গেছে। এতে স্লিপারগুলো নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় লোকজন এক পাশে বাঁশের ফাঁলি দিয়ে পেরেক সেটে দিয়েছেন। সেটিও দীর্ঘদিনে পঁচে নষ্ট হয়ে ভেঙে গেছে।
ব্রিজটির দুই দিকে নেই কোনো সতর্কতা সংকেত। এর ওপর দিয়ে শিক্ষার্থীসহ বহু মানুষ চলাচল করার সময় পা ফসকে যাতে পড়ে না যায়, সে জন্য স্থানীয়রা দুই লাইনের মাঝে কাঠের ফালি বিছিয়ে দিয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, ব্রিজের দক্ষিণে হাওয়াখালী ও গোলাবাড়ি গ্রামের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী প্রতিদিন এই ব্রিজ পার হয়ে মশাখালী চাইর বাড়িয়া ফাজিল মাদরাসা, মশাখালী গাল্স ও বয়েস হাইস্কুলে পড়তে আসে। এ ছাড়াও প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রতিদিন এই ব্রিজ পাড় হয়ে মশাখালী বাজারে আসা যাওয়া করেন।
মশাখালী থেকে কাওরাইদ গয়েশপুর পর্যন্ত রেলের পাশে পাকা সড়ক থাকলেও শীলা নদীর এই স্থানে সড়ক সংযোগ ব্রিজ নেই। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই মানুষ রেলব্রিজের ওপর দিয়ে চলাচল করছে। তবে লোকজনের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে শীলা রেলব্রিজের পশ্চিম পাশে একটি সংযোগ ব্রিজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে জন্য নদীর তলদেশের মাটিও পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীত হবে বলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখানে ব্রিজ নির্মাণে আপত্তি জানালে উদ্যোগটি ভেস্তে যায়।
গোলাবাড়ি গ্রামের মিজানুর রহমান, ইলিয়াজ মিয়া, চানু মিয়া ও মশাখালী গ্রামের আজিজুর রহমান বলেন, গোলাবাড়ি ও হাওয়াখালী গ্রাম থেকে ভোর বেলা কয়েকশ জেলে মাছ বিক্রি করতে মশাখালী বাজারে আসেন। দুই শতাধিক শিক্ষার্থী পড়ালেখা করতে আসে। আর সারাদিন তো মানুষের আসা যাওয়া আছেই।
মশাখালী টানপাড়া গ্রামের কলেজ শিক্ষার্থী আলতাফ হোসেন রামীম বলেন, ‘ভয়, আতঙ্ক, দুর্ঘটনার আশঙ্কা মাথায় নিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য শিক্ষার্থী ও নারী-শিশু এই রেলব্রিজ পাড় হন। ট্রেন চলে আসার আতঙ্কে তাড়াতাড়ি পার হতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনাও ঘটে। রেলের পাশের রাস্তার জন্য এখানে একটি ব্রিজ খুবই প্রয়োজন।’
গফরগাঁওয়ের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ময়মনসিংহ রেলওয়ের উর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) রেজাউল করিম বলেন, ‘আমার সেকশনে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ রেলব্রিজ নেই। রেল লাইনের ওপর দিয়ে চলাচল করা নিষেধ। লোকজন নিজ দায়িত্বে শীলা রেলব্রিজ পার হচ্ছেন। এতে রেলের কোনো দায়দায়িত্ব নেই।’
উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী তফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘এলাকাবাসীর কষ্টের কথা চিন্তা করে সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল শীলা রেল ব্রিজের পাশে ৬০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সড়ক ব্রিজ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে জন্য মাটিও পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু রেলের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণে ব্রিজটি করা সম্ভব হয়নি।’